সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :
বাংলার লোকসংগীত অঙ্গনে নেমে এসেছে এক গভীর শোকের ছায়া।
সিলেটের গৌরব গীতিকার ও সুরকার খোয়াজ মিয়া আর নেই! সবাইকে কাঁদিয়ে চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...
আজ ২৬ জুন বৃহস্পতিবার বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন- গীতিকার, মরমি সাধক ও আধ্যাত্মিক লোকশিল্পী খোয়াজ মিয়া। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ এবং মানবতাবাদী সংগীতসাধক। তাঁর লেখা বহু গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে যুগের পর যুগ। “লাগাইয়া পিরিতের ডুরি, আলগা থাইকা টানেরে...” কিংবা “আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু” — এমন অসংখ্য গানে মিশে আছে প্রেম, আত্মার টান এবং আধ্যাত্মিক সত্যের সন্ধান।
শৈশব ও সংগীতের প্রতি অনুরাগ
১৯৪২ সালের ১২ মার্চ সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খোয়াজ মিয়া। পিতা মৌলভী আজিজুর রহমান ও মাতা মোছা: আছতুরা বিবির সন্তান তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সংগীতপ্রেমী। স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে বাঁশি ও গানের প্রতি তার টান ছিল বেশি। পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি গ্রাম-গঞ্জে গান গেয়ে বেড়াতেন।
আধ্যাত্মিক সংগীতের পথে যাত্রা
১৯৬২ সালে তিনি দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সংগীতকে আধ্যাত্মিক ভাবনায় রূপ দিতে শুরু করেন। তাঁর গানে ধর্ম, মানবতা, প্রেম ও সমাজবোধের দার্শনিক ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। “প্রেমাগুনে দেহ আত্মা, করো ভাজা ভাজা” — এমন গানগুলো ছিল আত্মজিজ্ঞাসা ও হৃদয়ঘন কথার সংমিশ্রণ।
জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক স্বীকৃতি
ডলি সায়ন্তনী, শিমুল খান, সাজ্জাদ নূরসহ দেশের বহু খ্যাতিমান শিল্পী তাঁর লেখা গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তাঁর লেখা অনেক গানই অ্যালবামের শিরোনাম হয়েছে। বিশেষত সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক প্রিয় নাম।
ব্যক্তিজীবন: গানের ভেতরেও নিঃসঙ্গতা
খোয়াজ মিয়ার ব্যক্তিজীবন ছিল বিচিত্র ও বেদনাময়। তিনবার বিবাহিত হলেও তিনি কখনো সংসারজীবনে স্থিত হতে পারেননি। প্রথম স্ত্রী সন্তান জন্মের কিছুদিন পর মানসিক ভারসাম্য হারান, দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানদের জন্ম দিয়ে অকালপ্রয়াত হন। তৃতীয় সংসারে তিনি আরও চার সন্তানের জন্ম দেন। সবমিলিয়ে নয় সন্তানের পিতা হলেও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এক সাধক, যিনি সংসারের দায় টানতে টানতে গানকেই বাঁচিয়ে রেখেছেন হৃদয়ে।
যুক্তরাজ্য সফর: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুরের স্বীকৃতি
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন খোয়াজ মিয়া। লন্ডন ও ম্যানচেস্টারসহ কয়েকটি শহরে বাঙালি কমিউনিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি নিজের লেখা মরমি গান পরিবেশন করেন। প্রবাসী শ্রোতাদের হৃদয়ে তাঁর গান নতুন করে নাড়া দেয়। সেই সফর ছিল তাঁর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এক অধ্যায়।
আমাদের করণীয়
খোয়াজ মিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে শুধু একজন গীতিকার নয়, আমরা হারালাম এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শককে।
এখন আমাদের দায়িত্ব—
তাঁর গানের সংগ্রহ সংরক্ষণ করা
একটি সংগীত আর্কাইভ গড়ে তোলা
রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সম্মানিত করার দাবি জানানো
নতুন প্রজন্মকে তাঁর সংগীতচেতনার সঙ্গে পরিচিত করা
শেষ বিদায়
খোয়াজ মিয়া ছিলেন এমন একজন শিল্পী, যিনি লোকসংগীতের পরতে পরতে আত্মার গল্প বলতেন। তিনি সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গানের পেছনে ছুটেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমরা হারালাম একজন সাধক, একজন স্রষ্টা, একজন মানবিক শিল্পীকে।
তাঁর লেখা গান যেমন চিরকাল বেঁচে থাকবে, তেমনি বেঁচে থাকবে তাঁর সুরে বাঁধা আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি।
মন্তব্য করুন