প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হতাশা প্রকাশ ও পদত্যাগ করার ভাবনা প্রসঙ্গে নানা আলোচনার জন্ম হয়েছে। দেশের স্বার্থে দ্রুত এ সংকটের উত্তরণ ঘটাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক বাঁকে মোড় নিতে পারে। যুগান্তরের কাছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।
বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর সমর্থনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এখন সরকারের তরফ থেকেই বলা হচ্ছে তাদের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তাদের পদত্যাগও দাবি করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনা প্রকাশ্যে আসে। ওই আলোচনার পর দেশের পরিস্থিতি দ্রুত নাটকীয় মোড় নেয়। ড. ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেই আলোচনাই এখন চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, এ মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে তা দেশের জন্য ভয়ংকর সমস্যা সৃষ্টি করবে। ওই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার মতো সক্ষমতা দেশের নেই। তিনি বলেন, দেশে এই অনৈক্যের পেছনে পরিকল্পিতভাবে কলকাঠি নাড়ছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতীয় আধিপত্যবাদ। কোনো না কোনোভাবে গোলযোগ দেখিয়ে, দেশ শাসনে ব্যর্থতা দেখিয়ে এখানে আবার পতিত ফ্যাসিবাদীদের নিয়ে আসতে চাচ্ছে।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এর ফল হবে এতটাই ভয়াবহ যে, আমরা এবং আমাদের পরের প্রজন্মকে মাশুল গুনতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত সব শক্তির ঐক্য প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য তারা এখন একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব যত বাড়বে, প্রতিপক্ষ ততই সুযোগ নেবে। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। ওই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সবাইকে প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সেই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব, বিএনপি, জামায়াতসহ সব দল সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। এত বড় সমর্থন পাওয়ার পরও সেই সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ কেন আসছে-এমন প্রশ্ন তুলছেন রাজনীতিক ও বিশ্লেষকরা।
কেউ কেউ বলেন, এ পরিস্থিতির জন্য সরকারেরও দায় রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলগুলোর দূরত্ব কমানো জরুরি।
তারা আরও বলেন, ‘চলামান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য জরুরি।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার কম কথা বলছে। কোনো কোনো উপদেষ্টার মনোভাব এমন-এটি একটি নিয়মিত সরকার। এছাড়া নির্বাচন, গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শুধু তাই নয়, সরকার এমন অনেক ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের উপদেষ্টা করেছেন, যারা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে চুপ থাকার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তে তাদের সহযোগিতা করেছেন। এসব উপদেষ্টাকে দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে না। এসব কারণে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি উত্তরণে সরকার ও রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। যেসব রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি রয়েছে, তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করে দেশ চালাতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের ক্ষমতার কাঠামোয় পরিবর্তন আনা জরুরি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন-এমন ব্যক্তিদের সেখানে বসানো দরকার।’