মহান মে দিবস আজ। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। কুলি মজুর শ্রমিকদের দিন। কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সংহতি প্রকাশের দিন আজ। খেটে খাওয়া শ্রমিকদের উৎসবের দিন। গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই দিন। তাদের প্রতি সংহতি ও অধিকার আদায়ের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছে আজকের এই দিন।
মহান এই দিনটি এমনি এমনি আসেনি। এ দিন প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক রক্তভেজা ইতিহাস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারী, বেসরকারী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচী। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দিনটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিনটি স্মরণে আজ বিভিন্ন কর্মসূচীর পাশাপাশি শোভাযাত্রা, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। মহান মে দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার পত্রিকা অফিসগুলো বন্ধ থাকছে।
ইতিহাসের পাতায় মে দিবসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এদিন এলেই মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দেয়। এ দিন প্রমাণ করে দিয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিকে গলা টিপে হত্যা করা যায় না। তাদের ন্যায় সঙ্গত দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়। শ্রমিকের আন্দোলনের কারণে আজ ৮ ঘণ্টা কাজ করার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই শ্রমিকের এ দাবিকে আইনে পরিণত করেছে। তবে দুখের বিষয় যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ বাংলাদেশের সেইসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে দিনটির তাৎপর্য আজও ভালভাবে পৌঁছায়নি। অনেক দিনমজুর, গৃহশ্রমিক জানে না মে দিবস কী?
শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মে দিবস পালনের করা হলেও তাদের অধিকার কতটুকু রক্ষা রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে মে দিবসের দিনেও দেশে প্রায় ৮৩ ভাগ শ্রমিক কাজ করে থাকেন। এমনকি দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টায় সীমিত রাখার দাবিতে আজকের এইদিন প্রতিষ্ঠা পেলেও দেশে শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে এই কর্মঘণ্টা মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের এক গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে কৌশলে ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি শ্রম আদায় করে নেয়া হচ্ছে। এমনকি কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সংখ্যায়ও দেশে দিন দিন বেড়ে চলছে।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সহিংসতায় ৮৮৮ শ্রমিক মারা গেছেন। এদের মধ্যে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৯৯। যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আর গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হন ১ হাজার ৯৩ শ্রমিক। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় সংবাদপত্র প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা।
প্রতিষ্ঠানটির হিসেব মতে, ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬৯৯ আর সহিংসতায় ১৮৯ শ্রমিক মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৮২৪ পুরুষ আর ৬৮ নারী। ২০১৫ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৬৩।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা যাচ্ছে। গত বছর দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন ২৪৯ শ্রমিক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৫ শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে নির্মাণ খাতে। মৎস্য খাতে ৫২, কৃষি খাতে ৪৬ এবং প্যাকেজিং খাতে ৩৯ শ্রমিক মারা গেছে। প্যাকেজিং খাতের অধিকাংশই মারা গেছে টঙ্গীর টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায়। অন্য বছর পোশাক খাতে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা বেশি থাকলেও গত বছর পোশাক খাতে মারা গেছেন নয়জন।
এতে উল্লেখ করা হয় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিহত হওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, উঁচু ভবন থেকে পড়ে যাওয়া, অগ্নিকা-, বিষাক্ত গ্যাস, বয়লার বিস্ফোরণ। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রম ও নিয়োগপত্র নিশ্চিত করা। এই দুটি অদিকা অর্জনে দেশ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলে নিয়োগপত্র না থাকলে শ্রমিকে কাজে আসা অপরাধ। আবার দৈনিক ৮ ঘণ্টা বেশি শ্রম আদায় করা অপরাধ। প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। দিনের পর দিন তারা শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিতে যেসব আইন ও নীতিমালা রয়েছে, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মে দিবসের মূল দাবি আট ঘণ্টার কাজের বিষয়টি বাংলাদেশে খুব একটা মানা হয় না।