ডেস্ক রিপোর্ট : দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। শুধুমাত্র এ মাসেই এখন পর্যন্ত ৩৬ জন মারা গেছেন। এছাড়া এ বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় গত আড়াই মাসে রোগী বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ এবং মৃত্যু বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সিলেটসহ অন্যান্য জেলায়ও। সিলেটের এক সাংবাদিকও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তিনি ছাড়াও সিলেটের হাসপাতালগুলোতে অনেকেই ভর্তি হয়েছেন। এ সংখ্যা অর্ধশতের নিচে নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এখনই ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেখা যায় গত কয়েক মাসের তুলনায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাস শেষে মোট রোগী ছিল ৩ হাজার ৬৫১ জন এবং মৃত্যু ছিল ৪৪ জন। আড়াই মাস পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ হাজার ৭৯ ও মৃত্যু ১১৯।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে আরো দুই মাস আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এখনও যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে, অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।প্রতিবছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তারা এটাকে চাকরি হিসেবে দেখছে, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
একইসাথে রোগীর অসচেতনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর যথাযথ চিকিৎসা না করেই অন্য হাসপাতালে রেফার করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের দুর্বলতা প্রতিবছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম নিয়ে বেশিরভাগ রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তাহলে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশন কী পদক্ষেপ নিয়েছে? গত বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মাথায় রেখে এ বছর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা পরিস্থিতি সামলাতে আসলে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?
মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর রেকর্ড নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন বাংলাদেশে অসচেতনতার কারণে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম, জ্বর নিয়ে অবহেলা করে ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হয়।
একইসাথে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণ সেগুলো কিন্তু দূর হয়নি। ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামনে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, বৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপ, এটা গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছে। এখন সেপ্টেম্বর মাস। ফলে সামনে অক্টোবর নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুঝুঁকি আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে।
তিনি বলেন, যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটা আছে আমাদের সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদেরকে মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসাথে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব একজায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। যতই ডাক্তার দেন, স্যালাইন দেন, ফ্লোরে রোগী রেখে কি সমাধান করা যায় নাকি? কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার।
অনেকক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগী প্লাটিলেট কমে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে যায়। অন্তিম অবস্থায় চিকিৎসা পাওয়া এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, একটি ডেঙ্গু রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই চিকিৎসা দিতে পারে। অথচ তা না করে জেলা হাসপাতালে ট্রান্সফার করে বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেয়। এতে যে টাইম লাগে এতে রোগীর প্লাজমালি কেইস হয়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। কমে গিয়ে এই রোগীটির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
কবিরুল বাশার বলেন, কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রতিবারই বলছি আমরা কাজ করছি, এটা করছি ,সেটা করছি। কিন্তু নাগরিকরা ফলাফল পাচ্ছে না। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ ঘটাতে হবে বলে মনে করছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
বিগত বেশ কয়েক বছরে এডিস মশার বিস্তার রোধ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সমালোচনার মুখে পড়েছিল। গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেড় হাজারের বেশি ছিল। যা দেশের অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সিলেট সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলোতে উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যা ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।