বৃহস্পতিবার ২৯ ধরণের পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে, এসব পণ্য বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
তিন দিন হলো ২৯ ধরনের কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু তাদের নির্ধারিত দামে গত তিন দিনে কোথাও ওই পণ্য কিনতে পারেননি ক্রেতারা, এমন অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।
আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘অযৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে বিপণন অধিদপ্তর দেশের মানুষের সাথে কৌতুক করছেন। ওই দামে পণ্য বিক্রি সম্ভব নয়।’
২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইনে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন উভয় দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। এটা বাস্তবায়নে বাধা দূর করতে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১-এ অধিদপ্তরকে জেলা, উপজেলা এবং বাজার ভিত্তিক সমন্বয় কমিটি গঠন করে পণ্যের দাম বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দু’জনেই বলেছেন, ‘আইনে ওইসব পণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। তারা বাস্তবায়ন করবে আশা করছি।’
জবাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: মাসুদ করিম বলেন, ‘আমরা বাস্তবায়নের জন্য অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। এরজন্য সরকারের অনেক সংস্থা আছে। আমরা মামলা করতে পারি।’
গত বৃহস্পতিবার ২৯ ধরনের পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে কোন পর্যায়ে কোন পণ্যের দাম কত হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৫ টাকা ৭৮ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে দাম ১৫১ টাকা ৮১ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১৬২ টাকা ৬৯ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা।
একইভাবে গরুর গোশতের উৎপাদন খরচ ৫৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে দাম প্রতি কেজি ৬০৫ টাকা ১৩ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ৬৩১ টাকা ৬৯ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সার কথা বলা হয়েছে।
ডিমের (এক পিস) উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৮১ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে দাম ৯ টাকা ৫ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ৯ টাকা ৬১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ টাকা ৪৯ পয়সা। দেশি পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ ৪৪ টাকা, উৎপাদক পর্যায়ে দাম ৪৪ টাকা ৩০ পয়সা, পাইকারি ৫৩ টাকা ২০ পয়সা, খুচরা ৬৫ টাক ৪০ পয়সা। এভাবে পণ্যগুলোর দাম কোন পর্যায়ে কত তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু বাজারে ব্রয়লার মুরগি কেজি ২২০ টাকা, গরুর গোশতের কেজি ৭৫০ টাকা, প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা, দেশি পেঁয়াজ কেজি ৮০-৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এই হিসেবে প্রতিটি পণ্যের দামই বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ ভাগ বেশি।
যৌক্তিক দাম বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তা জানতে কথা হয় জেলা পর্যায়ের কয়েকজন কৃষি বিপণন কর্মকর্তার সাথে। তারা জানান, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে যৌক্তিক মূল্য তালিকা জানিয়ে দিয়েছি। মূল্য তালিকা টানিয়ে দিয়েছি। তাদের ওই দামে বিক্রি করতে বলেছি। জেলায় জেলায় বাজার মূল্য মনিটরিং সমন্বয় কমিটি আছে তারাও এটা দেখবেন। যদি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হয় সেটা জেলার ডিসি সাহেবরা করবেন।’
তাদের কথা, ‘বাজারে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। আমরা এই দাম নির্ধারণ করে দিয়ে এখন সচেতনতা সৃষ্টি করছি। সবাইকে যৌক্তিক মূল্য জানাচ্ছি।’
তবে পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘তারা অফিসে বসে অযৌক্তিকভাবে দাম নির্ধারণ করেছেন। ব্রয়লার মুরগির এখন উৎপাদন খরচ কেজি ১৭৫ টাকা। তাহলে এটা খুচরা পর্যায়ে কিভাবে ১৭৫ টাকা বিক্রি হবে। ডিমের যা দাম নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচও তাই। ব্যবসা না হলে আমরা উৎপাদন কেন করব? এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। ওই দামে কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না। তারা সাধারণ মানুষের সাথে কৌতুক করছে।’
আর দেশ কৃষিপণ্য নেটওয়ার্কের এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আসলে কৃষিপণ্য পঁচনশীল। এখানে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। এছাড়া চাঁদাবাজদের উৎপাত আছে, অনেক মধ্যস্বত্বভোগী আছে। সেই কারণে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায়। যদি কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, আলাদা পরিবহন ও চাঁদাবাজি বন্ধ হতো তাহলে দাম কম হতো। ওগুলো বন্ধ না করে, বিবেচনায় না নিয়ে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেই দামে বাজারে পণ্য পাওয়া যাবে না।’
এর জবাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: মাসুদ করিম বলেন, ‘আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুই মাস কাজ করে দাম নির্ধারণ করেছি। প্রতিটি পর্যায়ে কথা বলেছি। ওয়ার্কশপ করেছি। ওনারা যা বলছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সঠিক দামই নির্ধারণ করেছি।’
বাজারে ওই দামে পণ্য পাওয়া কেন যাচ্ছে না তার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মাত্র ঘোষণা করেছি। প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। এটা আগে ছিল না। এখন সবাই তো জানলো যে- যৌক্তিক দাম কোনটি। এখন বাজার মনিটরিং-এর মাধ্যমে ঠিক হবে। এই দাম আগেই নির্ধারণ করার ম্যান্ডেট আমাদের ছিল। তবে নানা কারণে আমরা করতে পারিনি।’
বাস্তবায়ন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের পুরো মেশিনারিজের ওপর নির্ভর করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মোবাইল কোর্ট, আমাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ আরো অনেক এজেন্সি আছে তাদের সবার দায়িত্ব।’
আইনি ক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই দাম কেউ না মানলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আমরা অভিযোগ পেলে আদালতে মামলা করতে পারি। কিন্তু সরাসরি অভিযান পরিচালনা বা শাস্তি দিতে পারি না। আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করি না। এটা জেলা প্রশাসক, ভোক্তা অধিদপ্তরসহ আরো অনেক দপ্তর আছে যারা করে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারিক কাজ করি। ঢাকা শহরেই এক বছরে ৩০ হাজার অভিযোগ পড়েছে এবং অধিকাংশই নিস্পত্তি করেছি। এছাড়া ভোক্তা অধিকারের জন্য সচেতনতামূলক অনেক কাজ করি। বাজার মনিটরিং আমাদের কাজের ছোট একটি অংশ। সেটা আমরা করি৷ কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আছে। আইনে এটা তাদের কাজ। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য আমরা জেলা প্রশাসন, পুলিশ সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। আমাদের ৫৫টি টিম সারাদেশে কাজ করছে। এখন ওনারা (কৃষি বিপণন) চাইলেও পাবেন বলে আশা করি।’
মনিটরিং জোরদার করলে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার প্রভাব বাজারে পড়বে বলে মনে করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
তিনি বলেন, ‘তাদের এই কাজটি আগেই করা দরকার ছিল, দেরিতে হলেও করেছেন। এখন মনিটরিং করতে হবে। কৃষি বিভাগের লোকবল অনেক। উপজেলা পর্যন্ত তাদের অনেক লোকবল আছে।’
তার কথা, ‘আইনে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন উভয় দায়িত্বই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। দণ্ড ও জরিমানার বিধানও আইনে আছে। প্রয়োজন তাদের সক্রিয় হওয়া।’
এদিকে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও সোমবার বাজার দর নিয়ে বৈঠক ডেকেছে বলে জানা গেছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে