আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় সিলেটজুড়ে টাণ্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় শিশুরোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতালেও শিশু শয্যার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সিলেটে বিশেষায়িত কোন শিশু হাসপাতাল না থাকায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাড়ছে শিশু রোগীর চাপ। বাধ্য হয়ে এক বেডে ৪ জন শিশুকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সিলেটের একমাত্র প্রস্তাবিত শামসুদ্দিন বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল চালুর প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে।
এদিকে অনুমোদন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনবল সঙ্কটের কারণে ঘোষণাতেই থমকে আছে সিলেটের একমাত্র প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের কাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর হাসপাতালটি ২০০ শয্যায় উন্নীত করার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৮ বছর। এখন পর্যন্ত কোন কার্যক্রম শুরু হয়নি শিশু হাসপাতালের। এরই মধ্যে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সিলেট সফরে এসে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, অচিরেই বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের দীর্ঘদিন পরও চালু না হওয়ায় মন্ত্রীর আশ্বাস কতটুকু কাজ হবে এ নিয়ে সৃষ্ট সংশয় দিন দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ মন্ত্রীর নির্দেশনার ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিশেষায়িত হাসপাতাল চালুর কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালকে সিলেটের একক ‘করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ ২ বছরেরও বেশী সময় সেখানে চিকিৎসা চলে করোনা রোগীদের। করোনার সংক্রমণ কমে গেলে হাসপাতালটিতে ফের চালু হয় সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা। বর্হিবিভাগে রোগী দেখার পাশাপাশি সচল হয় সার্জারী ইউনিট। বর্তমানে হাসপাতালে সাধারণ রোগীরা আবাসিক/অনাবাসিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও লোকবল সংকটে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। আর গণপূর্ত বিভাগ ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় ২০০ শয্যায় উন্নীত করার কাজও শুরু হয়নি। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট নগরীর চৌহাট্টাস্থ সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালকে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালে রূপান্তর ও সংস্কার কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরপর বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এই টাকায় অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর হাসপাতালটিকে ২০০ শয্যায় উন্নীত করতে আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ২০০ শয্যায় উন্নীতকরণ কার্যক্রম শুরুই হয়নি। চালু হয়নি শিশু হাসপাতালের কার্যক্রমও। কাজ না হওয়া সেই সময়ে ফেরত যায় বরাদ্দের ১০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (বর্তমান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) চৌহাট্টা থেকে কাজল শাহ এলাকায় সরিয়ে নিলে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে পুরোনো হাসপাতালের স্থাপনা। ১৯৯২ সালে এটি সিলেট সদর হাসপাতাল হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সাল থেকে এটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল ছিল। ১৯৯৮ সালে সিলেট শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল নামকরণ করা হয়। তবে তখন তাড়াহুড়ো করে লোকবল ও যন্ত্রপাতি সংকট নিয়ে চালু হয় শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল। আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধাও ছিলো অনুপস্থিত। জরুরি বিভাগ থাকলেও চিকিৎসক না থাকায় শুরু থেকেই তা বন্ধ থাকে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল হিসেবে চালু করতে পদ সৃষ্টি করে জনবল নিয়োগের জন্য ২০১৫-১৬ সালে ৪ দফা চিঠি পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। তবে এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরমধ্যে ২০২০ থেকে ‘করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ ঘোষণা করে সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. নূরে আলম শামীম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, শামসুদ্দিন আহমদ বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে আমাদের কাছে নতুন কোন তথ্য নেই। শামসুদ্দিন হাসপাতালের পাশে নবনির্মিত ২০০ শয্যার জেলা হাসপাতালের নির্মাণকাজ চলছে। এটি চালুর ব্যাপারে গত সপ্তাহে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমতি হয়নি। ফলে লোকবলও নিয়োগ হয়নি। কেবল অবকাঠামো নির্মাণ করলেই হাসপাতাল হয় না। হাসপাতালের জন্য লোকবল, যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হয়। এসব না থাকায় বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল চালু করা যায়নি।
২০০ শয্যায় উন্নীত করতে বরাদ্দ অর্থ ফেরত যাওয়া প্রসঙ্গে ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, অর্থ বরাদ্দ হলেও কাজটি গণপূর্ত বিভাগ না স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ করবে তা নিয়ে ঝামেলা দেখা দেয়। শেষ সময়ে এসে সিদ্ধান্ত হয় গণপূর্ত বিভাগ কাজটি করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তারা কাজের নকশা জমা দিতে পারেনি। ফলে কাজ আর সামনে এগুতে পারেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে কাগজ-কলমে হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও জনবল নেই ৩০ শয্যা হাসপাতালেরও। করোনা সংক্রমণ বাড়ার পর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে এসে চালানো হয় এই হাসপাতালের কার্যক্রম।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূইয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালটির খুব প্রয়োজন। ওসমানী হাসপাতালে শিশুরোগী চাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমাদেরকে বাধ্য হয়ে এক বেডে ৪-৫ জন শিশুকেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। কারণ আমরা কোন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারিনা।
তিনি বলেন, অনুমোদন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনবল সংকট দূর করার জন্য গত মাসেও আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। সূত্র: দৈনিক জালালাবাদ