প্রতিনিধি ১৪ মে ২০২৩ , ৪:০০:১৫ প্রিন্ট সংস্করণ
ডেস্ক রিপোর্ট : ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে। এর মধ্যে শুধু সেন্ট মার্টিনেই ১২ শ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গতির বাতাস নিয়ে রোববার বিকাল ৩টার দিকে কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা।
৫ ঘণ্টাব্যাপী প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আঘাতে কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন ও উপকূল এলাকাসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসতবাড়ি, স্কুল-মাদ্রাসাসহ প্রায় ১০ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ছে। পানের বরজ, ফসলি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে গেছে।
রোববার সন্ধ্যার পর নামিয়ে ফেলা হয়েছে মহাবিপদ সংকেত। সন্ধ্যার পর আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ীতে ছুটে চলেছেন মানুষ।
সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, মোখার তাণ্ডব চলাকালে জোয়ার ছিল না। সমুদ্রের বুকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি দাঁড়িয়ে আছে। সেন্ট মার্টিনের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দ্বীপের ছোটবড় হাজারখানেক গাছ ভেঙে পড়েছে। গাছ ভেঙে পড়ে আহত হয়েছেন ১১ জন। কেউ নিহত হয়নি।
সেন্ট মার্টিনের আরেক বাসিন্দা জসিম উদ্দিন শুভ বলেন, মোখার তাণ্ডব যখন শুরু হয় তখন মনে হয়েছিল আর হয়তো বা কারও সঙ্গে দেখা হবে না। চোখের সামনে বাতাসে ঘরবাড়ি উড়িয়ে যেতে দেখছি। দ্বীপের মানুষ অনেক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, দ্বীপে মোখার তাণ্ডবে অনেক ঘরবাড়ি উড়ে গেছে। যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহয়তা দেওয়া হবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, মোখার তাণ্ডব সন্ধ্যার পর পুরোদমে শিথিল হয়ে গেছে। সিগন্যাল কমে এলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আড়াই লাখ মানুষ ঘরে ফিরতে পারবেন। সেন্ট মার্টিনে ১২ শ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও ১১ জন আহত হয়েছেন, জেলায় ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাহারছড়া উপকূল ইউনিয়নের মো. জুবায়ের ইসলাম জুয়েল বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা’য় দ্রুতগতিতে আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও আল্লাহর রহমতে আমরা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছি। তবে আমাদের এখানে রাস্তায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে। বাড়িতে গাছ পড়ছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি নুরুল আমিন বলেন, বাতাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের বসতির ওপরের ছাউনি উড়ে গেছে। পরিবারের লোকজনসহ আমরা নিরাপদে থাকার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির থেকে রক্ষা পেয়েছি। এখন এখানে শতশত বসতি লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে রাস্তা ঘাটে ভেঙে পড়ছে গাছপালা, শতাধিকের ওপরে ঘরবাড়িসহ স্কুল-মাদ্রাসা ভেঙে পড়ছে। এখনো ঘূর্ণিঝড় মোখা’র প্রভাব কমে গেছে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। যারা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তাদের সহযোগিতা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফ হয়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা’র মিয়ানমারের দিক অতিক্রম করে গেছে। সেন্ট মার্টিন-টেকনাফ ও রোহিঙ্গাসহ উপকূলে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। পাশাপাশি রাস্তায় গাছপালাসহ বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়ছে। আমরা সব খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেছি।
বাড়ী ফিরছেন মানুষ : কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবের পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরছেন সাধারণ মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া লোকজন বলছেন, ঘূর্ণিঝড় চলে গেছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাড়ি ফেরার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ জন্য তারা ফিরে যাচ্ছেন।
কক্সবাজার কুতুবদিয়া পাড়ার নুরুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে। শনিবার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। এখানে নানান ধরনের সমস্যা হয়েছে। তাই দ্রুত বাড়ি যেতে হবে।”
একই এলাকার ইয়াসমিন বলেন, “চেয়ারম্যান মেম্বাররা বাড়ি ফিরতে বলেছেন। এজন্য বাড়ি চলে যাচ্ছি। কারণ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার চেয়ে নিজের বাড়িতে থাকা অনেক ভালো।”
শুধু নুরুল ইসলাম ও ইয়াসমিন নয়, সাগরে বিপদসংকেত থাকা সত্ত্বেও আরও অনেকেই বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। কক্সবাজার উপকূল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে অধিকাংশ লোকজন বাসা-বাড়িতে চলে গেছেন।
তবে এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেছেন, ‘সাগরে এখনও বিপদসংকেত রয়ে গেছে। তাই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষদেরকে বাড়িতে ফিরতে নিষেধ করা হচ্ছে। এরপরও তারা কেন চলে যাচ্ছে জানা নেই।’
এদিকে, দিনব্যাপী তাণ্ডব শেষে সন্ধ্যার পর শান্ত হয় ঘূর্ণিঝড় মোখা। রোববার সকাল ৯টার দিকে এটি কক্সবাজার উপকুলে আঘাত হানে। ক্রমান্বয়ে বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। দুপুরের দিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানে। বাতাসের তীব্রতা সন্ধ্যা নাগাদ চলে। তবে সাগরে মরা কটাল (ভাটা) থাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়নি।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস প্রধান আবদুর রহমান জানান, রোববার সন্ধ্যার পর থেকে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব কমতে শুরু করছে। তবে আগামী দুইদিন সাগর উত্তাল এবং বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
মোখা এখনো গভীর নিম্নচাপ : অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে রোববার সন্ধ্যা ৬টায় উপকূল অতিক্রম করেছে। ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে মিয়ানমারের স্থলভাগে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি স্থলভাগের অভ্যন্তরে আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে।
রোববার সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
আবহাওয়া অফিস জানায়, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এছাড়া, মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এর আগে রোববার (১৪ মে) সন্ধ্যায় আবহাওয়া অফিসে ব্রিফিংয়ে আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেছিলেন, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ রোববার সকাল ৬টায় বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম শুরু করে। পরে বিকেল ৩টায় ঘূর্ণিঝড়ের মূলকেন্দ্র স্থলভাগে ওঠে। ক্রমান্বয়ে ঘূর্ণিঝড়ের পেছনের অংশ উপকূলে ওঠা প্রায় সম্পন্ন করে।
তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে দুপুর আড়াইটার সময় ঘূর্ণিঝড় মোখার সর্বোচ্চ ১৪৭ কিলোমিটার গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে, তখন সিগন্যাল তুলে নেওয়া হতে পারে। মূলত পরিস্থিতি ফেভার করলে সিগন্যাল কমানো হবে। তা না হলে থাকবে।
এদিকে বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে আছড়ে পড়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মিয়ানমারে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছেন।