প্রতিনিধি ৩ মার্চ ২০২৩ , ৬:৩৬:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
ডেস্ক রিপোর্ট : ভয়াবহ খরার ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এতে হুমকীর মুখে বোরো ধানসহ কৃষিজ পণ্য। বিগত প্রায় ১২৫ বছরের ইতিহাসে এমন অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টির কবলে পড়েনি দেশ। তাও এবার আগাম খরা। সেই সাথে চৈত্র-বৈশাখের মতোই প্রখর রোদের তেজ।
গত নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী টানা এই চার মাসে সারা দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অর্থাৎ বৃষ্টি ‘নেই’ হয়ে গেছে। এরমধ্যে গেল ফেব্রুয়ারী মাসে ৯৪ দশমিক ৭ ভাগই অনাবৃষ্টি। অথচ মৌসুমের এ সময়ে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারী) দেশে বিক্ষিপ্ত হালকা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এতে মাটি থাকে সতেজ। কিন্তু টানা চার মাস যাবৎ ‘স্বাভাবিক’ ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসেও দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি অর্থাৎ খরা-অনাবৃষ্টি অব্যাহত থাকারই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায়। এ অবস্থায় খরা-অনাবৃষ্টি চলবে কমপক্ষে টানা পাঁচ মাস। আসছে বর্ষা মৌসুমেও গত বছরের মতোই বৃষ্টি ঝরতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে কম। শুধু তাই নয়, খরা-অনাবৃষ্টি, তাপদাহ পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে দীর্ঘায়িত হয়ে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। শতবছরের মধ্যে রেকর্ড খরার ঝুঁকিতে পড়ছে সমগ্র দেশ। কৃষি জমিতে সেচের পানি ও খাবার পানির ভয়াবহ সঙ্কট আসন্ন। ইতোমধ্যে দেশের অনেক এলাকায় খরার আগাম প্রভাবে পানির টানাটানি এবং রোদে পুড়ে ফল-ফসল, শাক-সবজি ক্ষেত বিবর্ণ খাক হয়ে যাওয়ার খবর আসছে। খরা পরিস্থিতিতে দেশের সমগ্র কৃষি খাতে পানির সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এখনই সঙ্কট শুরু হয়েছে। তাছাড়া মাছ চাষে পানির ঘাটতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের উপর পড়েছে ক্ষতিকর প্রভাব। জ্বর-কাশি, শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। ফল-ফসলেও বেড়েছে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ।
আবহাওয়া ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ও ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ থেকে পালাবদলে ‘এল নিনো’র ধাক্কা অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতের ধারা পাল্টে গিয়ে খরতাপের দিকে ধাবিত হওয়ার কারণেই অকালে খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর পেছনে দায়ী আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। এ অবস্থায় আবহাওয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুক্ষ-রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। এ বছর বাংলাদেশসহ বিশ^জুড়ে তাপদাহ হতে পারে আরও অসহনীয়। বাড়বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ।
আমেরিকান আবহাওয়া সংস্থা ‘নোয়া’র বরাত দিয়ে অতি সম্প্রতি ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম থেকেই খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে খরা আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে অর্থাৎ ভরা বর্ষাকাল পর্যন্ত খরা বিলম্বিত হতে পারে। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ ব্যাহত হতে পারে কমবেশি। গতবছর ভরা বর্ষা মৌসুমে জুলাই’২২ইং মাসে দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫৭.৬ ভাগ ও আগস্ট মাসে ৩৬.৪ ভাগই বৃষ্টিপাতে ঘাটতি ছিল। এদিকে এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গরম বাতাসের একটি ‘উষ্ণ বলয়’ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণত তিন থেকে ছয় বছর পর এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে দেখা যায়।
জানা গেছে, বসন্ত ঋতুতেই আগাম খরা-অনাবৃষ্টির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্টক হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত নিচের দিকেই নামছে পানির স্তর। কোথাও ১০ থেকে ১৫ ফুট, কোথাও তা ৩০ থেকে ৫০ ফুটও নিচে নেমে গেছে। নলকুপে পানি উঠছে না। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ভূ-উপরিভাগে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, জলাশয়, পুকুরসহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। অনেক জায়গায় নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বসন্তকালেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রির সেলসিয়াসের আশপাশে উঠে গেছে।
ভয়াবহ খরা-অনাবৃষ্টির ঝুঁকি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. মনজুরুল হুদা জানান, আগেভাগেই খরা-অনাবৃষ্টি ও শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করছে। দেশে স্বাভাবিক যে হালকা বৃষ্টিটুকু হয় অনেকদিন তাও নেই। অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, মাছ চাষসহ সমগ্র কৃষি-খামার তীব্র সঙ্কটের মুখে রয়েছে। আম, লিচুসহ ফলের বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। রুগ্ন হচ্ছে। কৃষককে বাড়তি সেচ খরচ গুণতে হচ্ছে। কৃষি-খামারে সামগ্রিক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। ভূ-উপরিভাগের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের চাপ এখনই বেড়ে গেছে। এরফলে মাটির নিচে পানির স্টক কমে আসছে। পরিবেশ-প্রকৃতিতে ঘটছে বিপর্যয়।
শিলাবৃষ্টি-কালবৈশাখীর আভাস : গত চার মাসের মতোই চলতি মার্চ অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সার্বিকভাবে দেশে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম হতে পারে। এ মাসে দেশে ২ থেকে ৩ দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী ঝড় এবং একদিন তীব্র ধরনের কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপর দিয়ে ২ থেকে ৩টি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। মাঝারি তাপপ্রবাহে তাপমাত্রা থাকবে সর্বোচ্চ ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সে.। এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে।
বৃহস্পতিবার আবহাওয়া অধিদফতরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় মার্চ মাসের উপরোক্ত দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান। এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় (মাসের ২৩ তারিখে) যশোরে ৩৫.৪ ডিগ্রি সে.।