জাতীয়

ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা নেপথ্যে ৮ প্রতিষ্ঠান

  প্রতিনিধি ১২ মে ২০২২ , ৭:১৪:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ

ডেস্ক রিপোর্ট : : ভোজ্যতেল নিয়ে সংকট এখনো কাটছেনা। দেশব্যাপী ভোক্তা অধিকার ও মোবাইল কোর্টের অভিযানে মজুদ করা তেল উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। এদিকে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে থাকা আমদানিকারক ৮ প্রতিষ্ঠানের নাম বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হয়েছে মামলা। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এই মামলা দায়ের করেছে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে ৫ মে ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার। তবে দাম বাড়ার পরও সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় বিপাকে পড়েন ক্রেতারা। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন এবং কী দামে বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এর ভিত্তিতে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বুধবার মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এরই মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মামলার শুনানিতে অংশ নিতে নোটিশও পাঠিয়েছে কমিশন।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের ৮ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বুধবার মামলা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল), মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিল, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড।
প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিতে স্বাধীন অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে এ মামলা দায়ের করেছে। প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের ১৫(২)-এর ‘খ’ ধারা অনুযায়ী উৎপাদন, সরবরাহ, বাজার, কারিগরি উন্নয়ন, বিনিয়োগ বা সেবার সংস্থানকে সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে ওই ৮ কোম্পানীর বিরুদ্ধে।
কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে, সেগুলোর বিষয়ে শুনানি করা হবে। শুনানিতে অংশ নিতে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ পাঠিয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। আগামী ১৮ মে শুনানিতে অংশ নিতে ডাকা হয়েছে সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল), মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড এবং বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিলকে। বাকি ৪ প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডকে শুনানির জন্য ডাকা হয়েছে ১৯ মে।
৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত পৃথক মামলায় কোম্পানিগুলোর ‘বাজারে কর্তৃত্বময় অবস্থান’-এর অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ পণ্য বা সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, গুদামজাতকরণ বা অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তিতে বা যড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আবদ্ধ হতে পারবে না। এদিকে কমিশনের নিজস্ব অনুসন্ধান টিম বাজার পরিস্থিতি মনিটর করে ৮ কোম্পানির বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্রমতে, অনুসন্ধান টিমের রিপোর্ট এবং অন্য বিষয়াদি পর্যালোচনায় ১০ মে কমিশনের সভায় সর্বসম্মত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভার সিদ্ধান্ত মতে, ১১ মে পৃথক মামলা রুজু হয়।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বলছে, মূলত ভোজ্যতেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও বাজার কেন অস্থিতিশীল, কারা কারাসাজির মাধ্যমে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে, তাদের খুঁজে বের করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুনানির পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমিশন আর্থিক জরিমানা করতে পারে। আগের তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণ লেনদেন বা পণ্য বিক্রি করেছে তার ১০ শতাংশ অথবা ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত মুনাফার তিনগুণ এর মধ্যে যেটি বেশি জরিমানা হিসেবে সে পরিমাণ অর্থ আদায়ের বিধান রয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২১ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প খাতে) সুবিধায় আমদানি হওয়া ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) ভোজ্যতেলের শুল্কায়ন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, যার মূল্য ১৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। শুল্কায়ন বিবেচনায় টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের অধীনে আমদানি হয়েছে ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশ। শিল্প খাতে আমদানির কারণে এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান প্রথমেই কর পরিশোধ না করে বরং ট্যাংকে রাখা তেল খালাসের সময় ধাপে ধাপে পরিশোধের সুযোগ পায়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুবিধা নিয়ে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৬৩ টন শুল্কায়ন করে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে টিকে গ্রুপের মাধ্যমে, যা মোট আমদানির ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। স্থানীয় বাজারে পুষ্টি ব্র্যান্ড নামে ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে টিকে গ্রুপের আমদানীকৃত তেলের শুল্কায়ন হয়েছে ৫ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।
২০২১ সালে মেঘনা গ্রুপের আমদানীকৃত ভোজ্যতেল শুল্কায়ন হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯২ টন, যা মোট আমদানির ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মোড়কে ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে মেঘনা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির আমদানি হওয়া তেলের শুল্কায়ন মূল্য ৩ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা।
শিল্প সুবিধায় শুল্কায়ন হওয়া সিটি গ্রুপের আমদানীকৃত ভোজ্যতেলের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৫২০ টন, যা মোট আমদানির ১৯ দশমিক ১২ শতাংশ। দেশের বাজারে তীর ও সান ব্র্যান্ডের মোড়কে ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা তেলের শুল্কায়ন মূল্য ২০২১ সালে ছিল ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
জানা গিয়েছে, পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা সয়াবিন তেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। তবে দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পরিশোধিত পাম অয়েল। আমদানি তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি শুল্কায়ন হয়েছে ১২ লাখ ১৬ হাজার টন পরিশোধিত (রিফাইন্ড) পাম অয়েল। এর পরই রয়েছে অপরিশোধিত (ক্রুড) সয়াবিন ৬ লাখ ৩ হাজার টন। আমদানি হওয়া পাম অয়েলের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ দুই দেশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে সয়াবিন আসছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে।
২০২১ সালে এস আলম গ্রুপের আমদানীকৃত ভোজ্যতেল শুল্কায়ন হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৮৪৮ টন, যা মোট আমদানির ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এস আলম গ্রুপের আমদানি করা তেলের শুল্কায়ন মূল্য ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা।

আরও খবর

Sponsered content