ডেস্ক রিপোর্ট : জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সরব হচ্ছে মাঠের রাজনীতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তাদের কর্মসূচি সাজাতে তৎপর। বিএনপি বলছে, সেপ্টেম্বর তাদের টার্গেট। প্রায় অভিন্ন ভাষা জামায়াতেরও। অন্য দলও চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে এ মাসেই মাঠে নামার ইংগিত মিলছে। অপরদিকে চুড়ান্ত তৎরপতা বেড়েছে কূটনৈতিক পাড়ায়ও। সব মিলিয়ে চলতি সেপ্টেম্বরেই রাজনীতির মোড় ঘুরে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল শনিবার নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। এতে বলা যায়, বিএনপি-জামায়াতসহ অধিকাংশ দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়ায় রাজপথের গরম হাওয়া আরো উত্তপ্ত হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যেই নির্বাচন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা নেট দুনিয়ায় চলছে যুদ্ধ-প্রতিযুদ্ধ। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৮৩ জন বিশ্বনেতা তার বিরুদ্ধে মামলা ও জুলুম বন্ধের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটনসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য নেতা বিশ্ববাসীকে ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ড. ইউনূসকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজব-প্রপাগান্ডা চলছে। ড. ইউনূসের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে যখন প্রকাশ্যে বিতর্ক চলছে; তখন পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে চলছে রাজপথ দখলের প্রস্তুতি। ‘রাজপথ দখলে যার, জনমত পক্ষে তার’ প্রবাদটি উপজীব্য করে রাজপথ দখলের পরিকল্পনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ চায় কর্মসূচি পালন, রাষ্ট্রযন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে; বিএনপি চায় এই সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এক দফার আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দুই দলই রাজপথ কাঁপানোর টার্গেট নিয়েই মাঠে নামার মহাপরিকল্পনা নিচ্ছে।
গত ২৮ আগস্ট ‘উন্নয়ন ও শান্তি’ সমাবেশে আন্দোলনরত বিএনপিকে সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীরা প্রস্তুত হচ্ছে, আমরাও প্রস্তুত, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাড় দেয়া হবে না।
জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আঘাত এলে পাল্টা আঘাত করতে হবে। জনগণের সঙ্গে যারা প্রতারণা করে তাদের ছেড়ে আমি চলে যেতে পারি না। আমরা যুগে যুগে শুধু মার খাব না। এ জন্য দেশ স্বাধীন করিনি।
এ অবস্থায় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, চলতি সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় নামবে। আর বিএনপি সরকার পতনের একদফা দাবি নিয়ে মাঠে নামবে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। এটা আসলে আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার মতো। এতে দেশে চরম অস্থিরতা বাড়বে।
সত্যিই তাই, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এক দফা ঘোষণা করায় এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান সম্মতভাবেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এক দফা দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দলের এ চাওয়া নিয়ে ভোটের আগে সেপ্টেম্বর মাসকে গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়েই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ মাস থেকে মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং আরও সোচ্চার থাকার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটুও ছাড় দেওয়া হবে না এমন কৌশলই দলটির।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আমরা মাঠে নেমে গেছি এবং নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকব। আমরা মানুষকে নির্বাচনমুখী করার জন্য প্রচার চলাবো। আর যারা নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইবে তাদের প্রতিরোধ করব।
ওদিকে, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে সেপ্টেম্বরকেই টার্গেট করছে বিএনপি। তবে সেই কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
১ সেপ্টেম্বর ছিলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বলা হয়েছিল ওই দিন ঢাকায় ব্যাপক শো-ডাউন করে সরকার পতনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকায় ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বড় কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। তিনি দেশে ফিরেছেন গতকাল শনিবার। এখন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘেষাণা করা হবে।
জার্মানভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিএনপির নেতারা মনে করেন, সেপ্টেম্বর মাসেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটাতে হবে। বড় জোর অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে। এরপর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। তার আগে কিছু করতে না পারলে নির্বাচনের আবহ তৈরি হলে আর কিছু করা কঠিন হবে। তাদের কথা আন্দোলনের জন্য মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত আছে। কর্মসূচি দিলেই তা সফল হবে। তারা আরেকটি দিক বিবেচনায় রাখছে। তাহলো চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হলে সরকারের আচরণ কেমন হবে। সরকারের আচরণ দেখে তারা কর্মসূচি এবং এর কৌশল নির্ধারণ করবেন। হরতাল নিয়ে তাদের মধ্যে নানা বিতর্ক থাকলেও তা বিবেচনার বাইরে নেই। তবে জোর দেয়া হচ্ছে ঘেরাও এবং অবরোধের উপর। এরমধ্যে সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিচারালয় ঘোরাওয়ের কর্মসূচি থাকছে। ঢাকা অবরোধের কর্মসূচিও দেয়া হতে পারে। তবে কোনো কর্মসূচিই ধারাবাহিকভাবে ঘোষণা করা হবে না। একটি কর্মসূচি শেষে আরেকটি ঘোষণা করা হবে। কর্মসূচিতে কোনো বিরতি থাকবে না। সরকার যাতে আগেই কর্মসূচি ঠেকাতে প্রস্তুতি নিতে না পারে তাই এইধরনের কৌশল। একই সঙ্গে তারা মনে করছে সেপ্টেম্বরে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়বে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, সেপ্টেম্বরই আমাদের টার্গেট। এইমাসেই আমরা সরকারকে হটাতে চাই। আমরা নানা ধরনের ঘোরাও-অবরোধ ছাড়াও আরো নতুন কিছু কর্মসূচি দেব যা আগে প্রকাশ করা হবে না।
এদিকে, এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দলটি মাঠে সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু বার বার অনুমতি চেয়েও পুলিশের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেনা দলটি। তবুও চলতি সেপ্টেম্বরে জামায়াতও মাঠে নামতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) সরকারের সঙ্গে থাকবে কি-না সেটি এখনো পরিস্কার নয়। আভাস পাওয়া গেছে। চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটি বিএনপির দিকে ঝুঁকছে বলেই অনেকে মনে করছেন। যদিও কিছুদিন পূর্বে তিনি ভারত সফর করে এসেছেন। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত তারা পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সিদ্ধান্ত আসতে পারে এই সেপ্টেম্বরেই।
এদিকে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অবস্থানে। কোনো অবস্থাতেই দেশটি বাংলাদেশে আর একতরফা নির্বাচন চায়না। এ জন্যই গত মে মাসেই ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত ওই বক্তব্যটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় : ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেয় না। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনকে আমরা সমর্থন করি।’
Leave a Reply