নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় বিপর্যস্ত পুরো সিলেট। কয়েকদিনে থেকে বাড়ছে রোদের তীব্রতা। চতুর্দিকে অসুস্থতার খবর। ঘরে ঘরে বাড়ছে সর্দি জ¦রের রোগী। বহুমূখী সঙ্কটে থাকা সিলেটবাসীর জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।
শহর থেকে গ্রাম, সবখানে ভয়াবহ লোডশেডিং। তবে বেশি ভোগান্তির শিকার গ্রামীণ জনপদের মানুষ। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ যায়না, বরং মাঝে মাঝে আসে। শহরে এখন দিন, রাত নেই। যখন তখন চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। কখনো কখনো ১ ঘন্টার উপর হচ্ছে লোডশেডিং। এছাড়া মেরামত উন্নয়ন কাজের নামে বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিকভাবে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা পর্যন্ত চলছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। দিন রাতে ৪ থেকে ৫ বার লোডশেডিং হওয়া তো এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। বিদ্যুতের এমন বেহাল অবস্থা পুরো সিলেটজুড়ে।
জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলো পিডিবি’র অধীনে থাকায় অনেকটা রুটিন করে লোডশেডিং করা হয়। তবে গত ৪/৫ দিন ধরে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ সিলেটর বাসিন্দারা। এই লোডশেডিং কতদিন চলবে এ ব্যাপারে কোন উত্তর নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেটের কর্মকর্তাদের।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, তেল ও গ্যাস সংকটের কারণে সারাদেশের ন্যায় অনিদির্ষ্টকালের জন্য লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে সিলেট। টানা ৩ দিন ধরে সিলেটে গড়ে ৫০ মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। তেল ও গ্যাস সংকট নিরসন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০ মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করার নির্দেশনা দিয়েছে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার। লোডশেডিং সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে কন্ট্রোল করা হচ্ছে।
জানা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশে^ তেল সংকট দেখা দিয়েছে। তাই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতে প্রায় ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এদিকে বিবিয়ানা গ্যাস প্লান্ট সাটডাউনে আছে তাই গ্যাসের চাপ কম। এজন্য গ্যাসের যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে প্রায় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে সারা দেশে লোড ভাগ করে দিয়েছে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি)।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সূত্রে জানা যায়, তেল ও গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাই সারা দেশেই লোডশেডিং করতে বলা হয়েছে। সিলেটে ৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে বলা হয়েছে এনএলডিসি থেকে। তাই পিক আওয়ারে লোডশেডিং হবে। এই লোডশেডিং সিলেট কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে কন্ট্রোল করা হয়।
বিশ্ববাজারে দাম চড়া। তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। দেশে কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহ। রান্নার চুলা থেকে শিল্পের চাকাও ভুগছে গ্যাস সংকটে। আর গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বেড়েছে লোডশেডিং। জ্বালানি স্বল্পতার কারণে সন্ধ্যায় ১২০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হচ্ছে। ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে গড়ে উৎপাদন ১২ হাজার ৮১৮ মেগাওয়াট।
দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবি। রোববার সরবরাহ কমেছে ৮৫১ মেগাওয়াট। এজন্য সারা দেশেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয়। রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়াতেও বেড়েছে লোডশেডিং। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
সিলেট মহানগরীতে দিনে রাতে ৪ থেকে ৫ বার নেয়া হচ্ছে বিদ্যুত। এমনিতেই প্রচÐ গরমে নাকাল নগরবাসী। সিলেটের আবহাওয়া বর্তমানে উত্তপ্ত। তার ওপর দিনের সময় মতো বিদ্যুৎ থাকছে না। লোডশেডিংয়ের কারণে বৃদ্ধ ও শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, সোমবার সন্ধ্যা ৮টায় সর্বোচ্চ চাহিদা ধরে ১ হাজার ২৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় ৩৮০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে ১৫৫ মেগাওয়াট, খুলনায় ১৬০ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ১৬০ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় ১১০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ১১০ মেগাওয়াট, সিলেটে ৬০ মেগাওয়াট ও রংপুর অঞ্চলে ১৩৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেখানো হয়েছে। এই সময় সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এখন সর্বোচ্চ উৎপাদন করার সক্ষমতা ১২ হজার ৮১৮ মেগাওয়াট এবং সর্বনি¤œ উৎপাদন ১০ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট।
এদিকে, লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
অন্যদিকে গত ৩ জুলাই দেশে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে দেশে দৈনিক ১ হাজার ৭৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো, যা বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪ কোটি ২১ লাখের বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৪৮ টি। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী বিদ্যুৎসহ দেশে এখন উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানী করা হচ্ছে।
পিডিবি’র সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ-ই-আরেফিন বলেন, মঙ্গলবার আমার অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩০ মেগাওয়াট, আর বরাদ্দ পেয়েছি ২৩ মেগাওয়াট। তাই আমাদেরকে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। একটি এলাকায় গড়ে কমপক্ষে ৩ ঘন্টার মতো বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কবে নাগাদ এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেই ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে সহসা এই সঙ্কট সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই।
নগরীর বন্দরবাজারস্থ হাসান মার্কেটের ব্যবসায়ী সেলিম আহমদ বলেন, এমনিতেই বন্যায় বাসায় এবং ব্যবসায় দুইদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এরমধ্যে সরকারী নিয়মে রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করতে হবে। এটা মরার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছু নয়। যদিও ঈদ উপলক্ষে রাত ১০ টা পর্যন্ত দোকান খোলার অনুমতি পেয়েছি। কিন্তু এতে লাভ কি হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে ধস নেমেছে। জানিনা এবারের ঈদে কি করবো।
সুবিদবাজার বনকলাপাড়া এলাকার কলেজ ছাত্র সবুজ আহমদ বলেন, দিনে যেমন তেমন সন্ধ্যার পর লোডশেডিং হলে পড়ার মুড নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া রাতেও একাধিকবার কারেন্ট চলে যায়। ফলে পড়ালেখা ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। দিনের একটা সময় লোডশেডিংয়ের জন্য নির্ধারিত করে দিলে ভালো হয়। মানুষ লোডশেডিংয়ের সময় অন্য কাজ কাম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে।
Leave a Reply