ডেস্ক রিপোর্ট : বাজারে মোটা ও চিকন চালের দাম এখন বাড়তির দিকে। মান ও প্রকারভেদে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে বস্তায় (৫০ কেজি) ১০০-১৫০ টাকা। এছাড়া সুগন্ধি চালের দাম কেজিতে ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এ বিষয়ে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের ইচ্ছেমত দাম নির্ধারণের কারণে দেশে সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে। এজন্য উত্তরবঙ্গের রাইস মিল মালিক ও চালের করপোরেট কোম্পানিগুলোকে দায়ী করছেন তারা।
অন্যদিকে মিল মালিকরা বলছেন, সরকারের আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হওয়ায় ধানের দাম এখন কিছুটা বাড়তির দিকে। এরই ধারাবাহিকতায় দাম বেড়েছে চালেরও।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়ত থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, এক সপ্তাহ আগে এখানে জিরাশাইল সেদ্ধ চাল বিক্রি হয়েছিল বস্তাপ্রতি ২ হাজার ১০০ টাকায়। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া মিনিকেট (সেদ্ধ) বস্তাপ্রতি ২৫০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৭৫০ টাকা, স্বর্ণা (সেদ্ধ) ১৩০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৪৮০, মোটা (সেদ্ধ) ২৫০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২৫০, গুটি (সেদ্ধ) ১০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়, বাসমতী (সেদ্ধ) ২০০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। মোটা চালের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি সুগন্ধি ও সরু চালের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য উত্তরবঙ্গের রাইস মিল মালিক ও চালের করপোরেট কোম্পানিগুলোকে দায়ী করছেন তারা।
চাক্তাই চালপট্টির ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুগন্ধি চালের দরবৃদ্ধির মাধ্যমে চালের বাজারে দাম বাড়া শুরু হয়। সবগুলো রাইস মিল কোম্পানির পক্ষ থেকে চিনিগুঁড়াসহ বিভিন্ন সুগন্ধি চালের দাম বাড়ানোর পর একপর্যায়ে অন্যান্য চালের দামও বেড়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় পাইকারি পর্যায়ে সংগ্রহ ও মজুদপ্রবণতাও বেড়ে যায়। দেশের প্রধান প্রধান মোকাম থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়।
দেশের অন্যান্য স্থানেও পণ্যটির দরবৃদ্ধির পেছনে মিল থেকে সরবরাহ কমে যাওয়াকেই দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। নওগাঁ পৌর ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন বলেন, মিলগেটে চালের দাম বেড়েছে বস্তায় প্রায় ১০০-১৫০ টাকা। আবার আগের তুলনায় এখন কম সরবরাহ করছেন চালকল মালিকরা। ফলে আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে খুচরা পর্যায়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।
অন্যদিকে মিল মালিক ও আড়তদাররা বলছেন, কিছুদিন আগেও সরকারের চলমান ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এ অভিযান কিছুটা গতি পেয়েছে। এতে কৃষক পর্যায়েই ধানের দাম বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের দাম বেড়েছে মণে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বড় মোকাম ও মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এখন এরই প্রভাব দেখা যাচ্ছে দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোয়।
চাক্তাই চাল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, সারা দেশের চাল সরবরাহ হয় উত্তরবঙ্গ থেকে। সরকার ধান-চাল সংগ্রহ শুরু করায় ধানের দাম মণপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যার প্রভাবে পাইকারি পর্যায়ে চালের বাজার অস্থির হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে ধান-চাল সংগ্রহ শেষ হলে বাজার আবারো সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
খুচরা পর্যায়েই পণ্যটির দাম বেশি নেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন মিল ও মোকাম মালিকরা। এ বিষয়ে নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, সরকার কৃষক পর্যায়ে ধান-চাল সংগ্রহ করায় মিলাররা চাহিদামতো ধান পাচ্ছেন না। ফলে চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেশি দামেই ধান সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সারা দেশেই চালের চাহিদা হঠাৎ করেই কিছুটা বেড়েছে। বেশি দামে ধান কিনে সেটি বিক্রিতে দাম সামান্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বেশি দাম বাড়ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে ছয় লাখ টন ধান ও চার লাখ টন চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে সেদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্য রয়েছে তিন লাখ টন। আতপ চালের ক্রয় লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার টন। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহমূল্য ধরা হয়েছে ২৬ টাকা করে। এছাড়া কেজিপ্রতি সেদ্ধ চাল ৩৬ টাকায় ও আতপ চাল ৩৫ টাকায় সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এ চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অন্যদিকে নভেম্বরের শেষ দিকে শুরু হওয়া ধান সংগ্রহ অভিযানও একই দিনে (২৮ ফেব্রুয়ারি) শেষ হচ্ছে।
এদিকে দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সব ধরনের সুগন্ধি চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এক সপ্তাহ আগেও এখানে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) পুরনো চিনিগুঁড়া চাল পাইকারিতে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে এখানে পণ্যটির দাম বেড়েছে বস্তায় ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাইকারিতেই পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা করে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডেড নতুন চিনিগুঁড়া চালের দাম ৬০০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ টাকায়।
এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে শীত মৌসুমে বিভিন্ন উৎসব থাকায় সুগন্ধি চালের চাহিদা বেড়ে যায়। একসময় ছোট ছোট রাইস মিল ও উত্তরবঙ্গের অটো রাইস মিলগুলো সুগন্ধিসহ বিভিন্ন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে দেশের করপোরেট কোম্পানিগুলোও চাল বিপণনে এগিয়ে এসেছে। এতে চালের বাজারও কিছুটা ব্যক্তি নির্ভর হয়ে গেছে।
Leave a Reply