ডেস্ক রিপোর্ট : ছেলে ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র। নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। নির্বাচনী হলফনামাতেও জায়েদা খাতুনের পেশার ঘরে লেখা গৃহিণী। সেখানে প্রধান প্রতিপক্ষ আজমত উল্লা খান রীতিমতো ঝানু রাজনীতিবিদ। তার ওপর তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আপাতদৃষ্টিতে ভোটের মাঠে দুজনের লড়াই অসম হলেও সে লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছেন জায়েদা খাতুনই। আজমত উল্লাকে স্পষ্ট ব্যবধানে হারিয়ে গাজীপুরের নতুন মেয়র জায়েদা খাতুন।
বৃহস্পতিবার সকাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৪৮০টি কেন্দ্রে বিরতিহীনভাবে চলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হলেও চূড়ান্ত ফলাফল পেতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রাত দেড়টায় পাওয়া চূড়ান্ত ফল বলছে, নৌকা প্রতীকের আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়েছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন।
সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আজমত উল্লা পেয়েছেন দুই লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। দুজনের ভোটের ব্যবধান ১৬ হাজার ১৯৭। অথচ জায়েদা খাতুন যে ভোটে আজমত উল্লা খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তেমন আশাই কি কেউ করেছিল?
সাদা চোখে হিসাবটা এমন মনে হলেও জায়েদা খাতুনের নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন অনেকেই। তবে সেটি ব্যক্তি জায়েদা খাতুনের কোনো ক্যারিশমার কারণে নয়, বরং তার ছেলের কারণে। জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা যখনই বাতিল হয়েছে, তখন তার মা যে ছেলের ভোট ব্যাংকের পুরোটাই পাবেন, সেটি ছিল তাদের অনুমান। তবে তাতেও নৌকার প্রার্থীকে হারানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। সেখানে ‘সিমপ্যাথি কার্ড’ ভূমিকা রেখেছে বলেই মনে করছেন তারা।
গাজীপুরের ভোটাররা বলছেন, জায়েদা খাতুন নিজে রাজনীতিবিদ না হলেও তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুরের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও তার বাইরেও রয়েছে তার নিজস্ব বলয়। তার ওপর মেয়র পদ ও দলের সদস্যপদ হারানো, দলে ফেরার সুযোগ পাওয়ার পর আবারও বহিষ্কার, বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া— সবকিছু মিলিয়ে ‘সিমপ্যাথি কার্ড’ ছিল জাহাঙ্গীরের পক্ষে। তিনি প্রার্থী হতে না পারায় সেই ‘সিমপ্যাথি কার্ডে’র পুরো ফায়দাটাই পেয়েছেন তার মা জায়েদা খাতুন। আর তাতেই আজমত উল্লা খান পেরে ওঠেননি তার সঙ্গে।
২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির হাসান সরকারকে দুই লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়ে গাজীপুরের নগরপিতা হন তিনি। তবে মেয়র পদে মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি জাহাঙ্গীর।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্যের জের ধরে ২০২১ সালে বহিষ্কার হন দল থেকে। বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও। এরপর সাধারণ ক্ষমার আওতায় এ বছর যখন দলে ফিরলেন, সিটির আরেক নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এ নির্বাচনেও দল থেকে মনোনয়ন চাইলেন। কিন্তু দল বেছে নিল পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আজমত উল্লাকে। জাহাঙ্গীর অবশ্য দমলেন না। নিজের ভোটব্যাংকের ওপর আস্থা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন ‘বিদ্রোহী’ হলেও নির্বাচন করবেন।
যা ভাবা, তাই কাজ। গাজীপুর সিটিতে ‘বিদ্রোহী’ তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন জাহাঙ্গীর। তার সমর্থকরা বলছেন, তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, নির্বাচনে তিনি প্রার্থিতা হারাবেন। সে কারণেই তিনি মায়ের জন্যও মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন এবং জমা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাছাইয়ে জাহাঙ্গীর বাদ পড়লেও তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র টিকে যায়। জাহাঙ্গীর আদালতে গিয়েও প্রার্থিতা ফিরে পেতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তারই প্রতীকী প্রার্থী হিসেবে মাঠে থেকে যান জায়েদা খাতুন।
বৃহস্পতিবার দিনভর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে ভোটারদের ভোট দিতে। তাদের অনেকেই জাহাঙ্গীরের সমর্থক। নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি তারা। বলছিলেন, তারা বিশ্বাস করেন যে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। তারা নিজেরাও আওয়ামী লীগ করলেও ব্যক্তি জাহাঙ্গীরকে গাজীপুরের জন্য অপরিহার্যও মনে করেন। তাই শেষ পর্যন্ত তারা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেছেন। ভোটে জাহাঙ্গীর না থাকলেও তার মা-ই সরাসরি তার প্রতিনিধিত্ব করছেন। জায়েদা খাতুনের জয়ের ব্যাপারে তাই তারা আশাবাদী ছিলেন।
বেশ কয়েকজন সাধারণ ভোটার, তথা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর সমর্থক নন এমন, তাদের সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের কেউ কেউ আজমত উল্লার জয়ের সম্ভাবনার পক্ষে মন্তব্য করেন। তবে কেউ কেউ জায়েদা খাতুনের জয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। তারা বলছিলেন, নারী প্রার্থী হিসেবে জায়েদা খাতুন ভোটারদের মনোযোগ পেয়েছেন। তাছাড়া ছেলে প্রার্থী হতে পারেননি, তিনি ছেলের ন্যায় বিচারের জন্য এই বয়সে ভোটের মাঠে নেমেছেন— ভোটের মাঠে এ ধরনের প্রচারেও সহানুভূতি তথা ‘সিমপ্যাথী কার্ড’ জায়েদা খাতুনের পক্ষেই ছিল।
শেষ পর্যন্ত শেষোক্ত ভোটারদের অনুমানই সত্য হয়েছে। রাজনীতির মাঠে অভিষেকেই ‘চ্যাম্পিয়নের মতো’ খেলেছেন জায়েদা খাতুন। ভোটের মাঠে তাই শেষ হাসিটাই তারই। ছেলের ভোট ব্যাংক আর ‘সিমপ্যাথি কার্ড’ সঙ্গী করে গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুন, যিনি কি না দেশের দ্বিতীয় কোনো নারী মেয়র।
Leave a Reply